মনোরঞ্জন বড়াল



ধর্মীয় আচরণ ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ঠ অন্য ধর্মের লোকেদের প্রতি সর্বপ্রকারের বৈষম্যকে মেনে নিয়ে থাকতে হয় — ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোন দেশের পক্ষেই এটাই সত্য, তা যত মর্মান্তিক হোক না কেন। ধর্মীয় বিশ্বাসে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেদের একটা অংশের মধ্যে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষদের সক্রিয় অংশগ্রহনে ও সহযোগিতায় দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যতই প্রবল হয়ে উঠবে ততই ধর্মীয় বৈষম্যের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকবে।
কোন দেশে ও রাষ্ট্রে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদের পর ধর্মীয় ও অন্যান্য ব্যাধির উপর আঘাত হানার রাজনীতিগত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে মাত্র। কিন্তু বৈষম্য ব্যাধিগুলির জের, বিশেষ করে ধর্মীয় বৈষম্য ব্যাধির মতো সমাজজীবনের উপরিকাঠামোর (সুপারস্ট্রাকচার) প্রতিক্রিয়াশীল জের কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র্বব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার পরও দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে কোন ভুল ত্রুটি ঘটলে বৈষম্য ব্যাধিগুলির শিকড় আবার সতেজ হয়ে ওঠে যতদিন পর্যন্ত ভুল ত্রুটির সংশোধন না করা হয়।
—  মনোরঞ্জন বড়াল

নারায়ণ বিশ্বাস
কবি ও প্রাবন্ধিক


প্রান্তদেশ পত্রিকার সম্পাদক। কুরুক্ষেত্র সমাচার, যোগাযোগ কর্মী ও পথ সংকেত পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক।
সামাজিক ন্যায় ও প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ  সংগঠক।

ভিন্নকথা
জাতপাতের নিষিদ্ধ কথা
written by Abu Siddik March 26, 2024

“ভারতে ‘জাতপাত’ শব্দটি শুনেই অনেকে উপহাস করে, অনেকে রেগে যায়। জাতপাত শব্দটি সবসময় নির্যাতন ও বৈষম্যের সাথে যুক্ত।কেউ যদি জাতপাত নিয়ে কোন সদর্থক কথা বলে, তবুও তাকে আধুনিকতার বিরোধী ধরে নেওয়া হয়। শিক্ষিত সকলেই ভারতীয় সমাজে জাতপাত আছে বলে মানতে চাই না। কিন্তু সরকারি চাকরি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও বিয়ের সময় জাতপাত কে সামজিক সম্পদ হিসাবে ভাঙিয়ে নিতে আমরা অভ্যস্ত। জাতপাত তাই ভারতে একটি জটিল জায়গা জুড়ে আছে। “
আর বৈদ্যনাথন, কাস্ট এ্যজ সোশ্যাল ক্যাপিটাল, ২০১৯

চিন্তা যেমন বস্তুগত অবস্থানের উপর নির্ভর করে, তেমনি বস্তুগত অবস্থার পরিবর্তনে চিন্তার অনুশীলন অপরিহার্য। মানুষের অগ্রগতির শর্ত তার মুক্তি, আর সেই মুক্তি নিহিত এমন সমাজে যেখানে “ব্যক্তি মানুষ আর শ্রমবিভাজনের আজ্ঞানুবর্তী থাকবে না, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক শ্রম ও দৈহিক শ্রমের মধ্যে বৈপরীত্যের ধারণাটা অবলুপ্ত হয়ে যাবে”। এমন একটি সমাজ গড়ার পক্ষে অনেক বাধার মধ্যে অন্যতম প্রধান বাধা জাতপাতের সমস্যা। ভারতীয় সমাজে এই কুৎসিত বিভাজন নিয়ে নিরন্তর প্রশ্ন তোলা, তার স্বরূপ ও প্রকৃতিগুলোকে জনসমক্ষে তুলে ধরা দরকার। কিন্তু সেটা খুব কম হয়। জাতপাতের সমস্যাকে একদিকে বিদ্যাচর্চার বিষয় এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক অনুশীলনের বিষয় করে তোলা দরকার। 

ভারত বর্ষ এবং বিশেষ করে আমাদের এই রাজ্যে জাত বিভাজন ও তার দূর করার উপায় নিয়ে আলোচনা খুব খুব একটা হয় না। আর যেটুকু হয় সেটুকু প্রধানত ইংরেজি ভাষায় ও বিদ্যাচর্চার বিশেষ এক কাঠামো মেনে হয়। এতে করে আপামর জনগণের কাছে জাতপাতের সমস্যা বেশি বেশি করে উঠে আসে না। একটি নির্দিষ্ট বলয়ে এবং সেমিনার কক্ষে এই আলোচনাগুলো আবদ্ধ থাকে। এই জাতপাতের সমস্যাকে ভাঙ্গিয়ে অনেক বড় বড় বই লেখা হয় অনেক মনোরম এবং আকর্ষণীয় প্রবন্ধ বেরোই। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। বিষয়টিকে লোকচর্চার স্তরে নামে আনা দরকার, আর সেই কাজটিকে লেখক দেবেশ দাস করেছেন। তার এই বই একটি জরুরী রাজনৈতিক পদক্ষেপ একটি বুদ্ধি চর্চা গত অবদান, এবং এটি আমাদের এক সামাজিক সম্পদ। তথ্য ও তত্ত্বের মিলিত প্রয়াসে এটি একটি মূল্যবান দলিল গবেষক ও সাধারণ পাঠকের কাছে। বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন কথাগুলো কুমার রাণা।
প্রকাশক নারায়ণ বিশ্বাস বলেছেন স্বাধীনতার এত বছর পরে সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া দলিত ও আদিবাসীদের প্রকৃত অবস্থান এখন কেমন? অন্যান্য অনগ্রসরদের অবস্থাই বা কেমন? দলিত আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যান্যদের ফারাক কমেছে না বৃদ্ধি পেয়েছে? লেখক এসবের উত্তর খুঁজেছেন সরকারি পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করেই। উঠে এসেছে দলিত ও আদিবাসীদের অবস্থান নিয়ে কথা। আইনসভা বিচার ব্যবস্থা আমলাতন্ত্র ও মিডিয়ায় দলিত আদিবাসীদের উপস্থিতির কথা। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে তাদের করুন অবস্থান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক। উঠে এসেছে দলিত ও আদিবাসীদের সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। এটিকে অনেকেই সেনসিটিভ ইস্যু হিসাবে তুলে ধরে। সে কারণে লেখক যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও তার বিরুদ্ধে ওঠা নানা বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আন্তরিক চেষ্টা করেছেন।

মুখবন্ধ বাদ দিয়ে মোট ১৬ টি অধ্যায়ে ১৪৪ পাতার এই বইটিতে দলিত আদিবাসীদের বহুমাত্রিক বঞ্চনার কথা উঠে এসেছে। অধ্যায়গুলির নামকরণ লেখকের সুচিন্তার বহিঃপ্রকাশ। যেমন দলিত আদিবাসীরা কতটা পিছিয়ে আছে? কেন পিছিয়ে পড়েছে? মেধার অভাব? জাত, জাতপাতের উৎস, জাতপাতের পরম্পরা জাত ব্যবস্থায় ক্ষতি, দেশের সংরক্ষণে সমাধানের প্রয়াস, সংরক্ষণ নিয়ে নানা আপত্তি বনাম অন্য কথা, কিপথে এগুনো যায়? কবে শেষ হবে জাতপাত? ইত্যাদি ইত্যাদি। 

জাতপাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বর্ণ ব্যবস্থার বিলোপের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাওয়া সমাজতান্ত্রিক শক্তির সদর্থক ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু লেখক কিছুটা আশাহত, “পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখা গেছে যে সমাজতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের মাধ্যমে বিপ্লব হয়ে গেলেও সেখানে ধর্ম উঠে যায়নি। আমাদের দেশে যেখানে জাতপাতের উৎস হচ্ছে ধর্ম সেখানে ধর্ম থাকবে, অথচ জাতপাত থাকবে না, এখনই এটা ভাবা যাচ্ছে না”।

প্রশ্ন হল জাতপাত থাকলে কি করে একটি আদর্শ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। লেখক আশা করেছেন যে মার্কস ও এঙ্গেলস বর্ণিত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটলে অনেকটাই লাভবান হবে দলিত আদিবাসী প্রান্তিক মানুষরা। তাই দলিত আদিবাসীদের স্বার্থ যারা দেখেন দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদেরকে বলতে হবে l আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই আসলে দেশের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই। শাসক শ্রেণীর এই শাসনকে না হটিয়ে জাতপাত ব্যবস্থাকে হটানো যাবে না।
দেশের আর সব কিছু বাদ দিয়ে এখন যদি কোন ব্যক্তি বিচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই আন্তরিক লড়াই করতে চাই তাকে এই শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তাই জাতপাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তাদের সমর্থন করতে হবে। লেখকের কথায় শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গেই জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইটাও জরুরী। কেউ ভাবতে পারেন যে সেই যখন শ্রেণী সংগ্রামে আসতে হলো তাহলে শুধু শ্রেণীর সংগ্রামের কথাই ভাবা হবে না কেন? যদি জাতপাতের সমস্যা কি এড়িয়ে শুধু শ্রেণী সংগ্রামের কথা ভাবি তাহলে সমস্যা আছে। কারণ তাতে জাতপাতের সমস্যা থেকেই যাবে আর তা পদে পদে বাধা দেবে শ্রেণী সংগ্রামকেই।
তথ্যভিত্তিক আলোচনা অল্পপরিসরে করা কঠিন ও তা সবসময় লাভজনক নাও হতে পারে, কারণ জ্ঞানীদের জ্ঞানদান অপাত্রে দানের স্বরূপ। অর্থাৎ দলিত এবং আদিবাসীদের করুণ হাল সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই। এটি কম-বেশি সকলেরই জানা। তাছাড়া উৎসাহী পাঠকেরা এই তথ্যগুলি একটু চেষ্টা করলে পেতে পারেন। এখন ইন্টারনেটের যুগ। আর্টিকেলের ছড়াছড়ি। ইংরেজি ভাষায় বইপত্র আছে অনেক। এবং দলিত আদিবাসীদের উপর নির্যাতন অত্যাচার বৈষম্য, অপবাদ ইত্যাদির কথা শিক্ষিত ভারতবাসীর কাছে অধরা নয়। তাই আমলাতন্ত্রে প্রশাসনে বিচার ব্যবস্থায় আইন বিভাগে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আরো নানারকম সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কাঠামোয় এমনকি বিভিন্ন জনকল্যাণকর পার্টির সাংগঠনিক কমিটি গুলোতে, পাড়ার ক্লাবে, সর্বহারার দলগুলোতে, তাদের সংখ্যা কত আছে সেটা অনেকেই জানেন। নমুনা হিসাবে একটি তালিকা দেওয়া হল। এরকম অসংখ্য তথ্য লেখক খুব যত্নসহকারে পেশ করেছেন উনার বক্তব্যের স্বপক্ষে।

প্রান্তদেশ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী
GET IN TOUCH​

We value the connection with our community and are here to assist in any way we can. Feel free to reach out through the following channels:

First Name
Email
Message
The form has been submitted successfully!
There has been some error while submitting the form. Please verify all form fields again.
Phone

+91 – 877 778 5294

Email

info@pathasanketprakasani.in

Address

Nibedita Park, Hridaypur, Kolkata 700127

Follow us:
Shopping Cart
Scroll to Top